এক সময় যারা আগ্রহ দেখিয়ে রোহিংগাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এখন তারাই উল্টো চাপের মধ্যে রয়েছেন । এক বছরের ব্যবধানেই কক্সবাজারের সীমান্তবর্তি এলাকাগুলোর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে ।
উখিয়ার বালুখালি এলাকার বাসিন্দা মোমেনা বেগম বলেন, “রোহিংগারা যখন আসতে শুরু করলো তখন নিজের জমিতে ৭০টি রোহিংগা পরিবারকে ঘর তুলে দিয়েছিলাম । এখন সেই জমি ফেরত পাচ্ছিনা । নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারও করতে পারছিনা । আর কোনদিন জমি ফেরত পাবো কিনা সেটা নিয়ে শংকায় আছি ।” “নিজের টাকায় রোহিংগাদের ঘর তুলে দিয়েছিলাম আর এখন কিছু বলতে গেলেই দা বটি নিয়ে তেড়ে আসে”।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিংগাদের যেন নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সেই ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । তবে এখন পর্যন্ত তারা এই বিষয়ে সফল হতে পারেনি । আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও বাংলাদেশ সরকার আশানরুপ সহযোগিতা পাচ্ছেনা । এদিকে প্রথমদিকে মায়ানমার রোহিংগাদের ফেরত নিবে বললেও এখন তারা এই বিষয়ে কথা বলতেই আগ্রহি নয় । মায়ানমার আদৌ রোহিংগাদের ফেরত নিতে চায় কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে ।
এদিকে দীর্ঘসময় পেরিয়ে গেলেও রোহিংগাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারও দুশ্চিন্তায় রয়েছে । বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সেখানকার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হচ্ছে। সেখানে ভীতির সঞ্চার হয়েছে।” “আমরা আশংকা করছি যে, নতুন করে অনেকে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।”
“…আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দ্রুত অগ্রগতি আশা করেছিলাম। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরো জোরালো ভূমিকা যেন আসে, সে বিষয়ে আমরা নতুন করে চেষ্টা করছি।”
এদিকে কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসনের মাঝেও দুশ্চিন্তা বেড়েছে । স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, টেকনাফ, উখিয়ার স্থানীয় জনসংখ্যা ৫ লাখ । অথচ আশ্রয় নেয়া রোহিংগাদের সংখ্যা ১১লাখেরও বেশি । সুতরাং স্থানীয়দের চাইতে রোহিংগাদের সংখ্যা এখন ২গুনেরও বেশি । তাই স্থানীয়রাই এখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন ।
স্থানীয় কর্মকর্তারা আরো বলেন, এখানকার পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে । সামাজিক ভারসাম্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে । ছোট খাটো ঝগড়াঝাটি, মারামারি লেগেই থাকে । এখানকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিখবে তা নিয়ে আমরা চিন্তায় আছি ।
এছাড়া মাদক, চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র, হানাহানি বেড়ে গিয়েছে । তাদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে । সংবাদিকদের মারধর, চুরি ছিনতাইও ঘটাচ্ছে । আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়েছে । পরিস্থিতি আর কতদিন আমরা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবো তা জানিনা ।এছাড়া রোহিংগাদের মাঝে অন্তত আড়াই হাজার এইডস আক্রান্ত । তাই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে ।
স্থানিয় কৃষক রিয়াদ মোহাম্মদ বলেন, রোহিংগাদের জায়গা দিতে গিয়ে তার চাষের জমি কমে গিয়েছে, ফলে আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি । তার চাষের জমিতেই রোহিংগারা ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখে । এছাড়া তার আম বাগান থেকে আগে বছরে ১ লাখ টাকার বেশি আম বিক্রি করতেন কিন্তু গতবার কিছুই বিক্রি করতে পারেননি । কাচা অবস্থাতেই সব আম পেড়ে খেয়ে ফেলেছে রোহিংগারা । অনুরোধ করলেও শোনেনা রোহিংগারা । এছাড়া বাড়ির মহিলারাও নিরাপদে বাইরে বের হতে পারেন না ।
এদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছে । বালুখালি ক্যাম্পের কাছেই বালুখালি কাশেমিয়া হাইস্কুল অবস্থিত । রোহিংগা নিবন্ধনের কাজে ব্যস্ত থাকায় স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম একবছর প্রায় বন্ধই ছিলো । স্কুলে সারাদিন রোহিংগাদের ভিড় লেগেই থাকে । গতবছর এস এস সি পরিক্ষায় স্কুলটির রেজাল্ট হয়েছে খুবই খারাপ । এবছর কোনরকমে শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও শিক্ষকরা রেজাল্ট নিয়ে খুব একটা আশাবাদি হতে পারছেন না ।
স্কুলে শিক্ষাথীর্র উপস্থিতি একেবারেরই কমে গেছে । স্কুলের আশেপাশে সারাদিন বিভিন্ন যুবকরা আড্ডাবাজি ও ঘোরাফেরা করে ।
এছাড়া রোহিংগাদের পিছনে প্রতি মাসে বাংলাদেশের খরচ হয় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । ফলে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বাংলদেশ ।
মোটকথা রোহিংগাদের কারনে স্থানীয় জনগন ও প্রশাসন উভয়েই চাপের মধ্যে রয়েছে । রোহিংগাদের সাথে বাংলাদেশীদের জীবনধারার (লাইফস্টাইলের) মিল না থাকায় সমাজে বিরুপ প্রভাব পরছে । তাই দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছেন সবাই ।
Add Comment