বাংলাদেশে আপনি যেদিকেই যাবেন, দুচোখ ভরে শুধু দোকান দেখেতে পাবেন। দোকান দেখতে দেখতে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। দেশের সবাই যেন দোকান নির্মানের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কল-কারখানা গড়ে তোলার প্রতি কারো আগ্রহ নেই, কারিগরি কাজের প্রতি কারো আগ্রহ নেই, কৃষি বা অন্য কোন উৎপাদনশীল কাজের প্রতি কারো আগ্রহ নেই, সবার আগ্রহ শুধু দোকানদারিতে!
যার ১ কোটি টাকা আছে সে ১ কোটি টাকায় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলে গড়ে তুলছে মার্কেট বা শপিংমল, যার ১ লাখ টাকা আছে সে কৃষি কাজ না করে গড়ে তুলছে মুদি দোকান, যার ১০ হাজার টাকা আছে সে ফেরিওয়ালা না হয়ে গড়ে তুলছে চা-সিগারেটের দোকান (আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় দোকান)। চারিদিকে শুধু দোকান আর দোকান। ভিন্ন কিছু করার চিন্তা কারো মাথাতেই আসছেনা, সবার চিন্তা চেতনায় শুধু দোকান আর দোকান।
দোকানদারির প্রতি দিনের পর দিন সবার চাহিদা এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হবে দোকানদারি স্টাডিজ নামের আলাদা বিভাগ, যেখানে দোকানদারির উপরে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করবে শিক্ষার্থীরা! তারপর গ্রামে ফিরে গিয়ে চালু করবে নিজের স্বপ্নের দোকান!
যাইহোক, এসব কথা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র একটি দেশ। সরকারি হিসেবে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি হয়েছে অনেক তবে বাস্তবে কার জীবনে কতটা অগ্রগতি হয়েছে সেটা সাধারন মানুষই ভালো বলতে পারবে।
যাই হোক, সেসব বিষয় নিয়ে আমি এখন কথা বলতে চাইনা। আমি আজ কথা বলতে চাচ্ছি অন্য একটি বিষয় নিয়ে। বিষয়টি হলো ব্যবসায়ের বৈচিত্র বা ভিন্নতা।
দুখ:জনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক জগতে বৈচিত্র নেই বললেই চলে। শুধু নির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিয়েই এদেশের মানুষ ব্যবসা করে থাকে। বিষয়টি খুবই বিপজ্জনক। কারন শুধু একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে থাকা কখনই সঠিক কাজ হতে পারেনা।
বাংলাদেশের মানুষ যে ব্যবসাগুলো বেশি পছন্দ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো দোকানদারি। এদেশে এত বেশি পরিমান দোকানপাট গড়ে উঠেছে যে বিভিন্ন শহর, মফস্বল বা গ্রামেও রাস্তার দুপাশে শুধু দোকান আর দোকান চোখে পড়ে। এত দোকানপাটের আসলেই কোন প্রয়োজন নেই। দোকানদারি করে এদেশে কেউ ১০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলেও আমার জানা নেই তবুও কেন মানুষ দোকানদারি করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পরে তা ভাবা দরকার।
বিষয়টি এদেশের মানুষের মেধা ও সৃষ্টিশীলতার অভাব এবং অলসতাকেই তুলে ধরে বলে আমার ধারনা। কারন দোকানদারি করতে খুব বেশি মেধার প্রয়োজন হয়না, সৃষ্টিশীল কিছুর চিন্তাও করতে হয়না, পাইকারি দামে মালপত্র কিনে কিছুটা বেশি দামে সেগুলো বিক্রি করাই হলো মূলত দোকানদারদের কাজ। আর সহজ ব্যবসা বলেই হয়তো অলস ও মেধাহীন লোকদের প্রথম পছন্দ দোকানদারি করা!
বহু বছর ধরেই দেশের যেখানেই গিয়েছি সেখানেই লক্ষ্য করছি, রাস্তার পাশে কারো জমি থাকলে তারা সেখানে কিছু দোকান নির্মান করে নিজে দোকানদারি করে এবং অন্যকেও দোকান ভাড়া দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই যথেস্ট পরিমান দোকান থাকা সত্বেও নতুন দোকান নির্মান করা হচ্ছে। যেখানে ৫ টা দোকান থাকলেই চলে সেখানে এখন দোকান হয়েছে ২০টা! ফলস্বরুপ কোন দোকানদারই বেশি লাভ করতে পারছেনা। সারাদিন বসে থেকে থেকে অল্প-স্বল্প কিছু মালামাল বিক্রি করে কোনরকমে টেনেটুনে সংসার চালাতে হচ্ছে। এমন বহু দোকান রয়েছে যেখানে সারাদিনে ৫০ জন ক্রেতাও যায়না।
দিন দিন যেভাবে দোকানপাটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে একসময় দেখা যাবে যে ক্রেতার চাইতে দোকানের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে।
বর্তমানে শহরে এমনকি মফস্বল বা গ্রামেও একটা জিনিস খুব চোখে পড়ছে, সেটা হলো বড় বড় মার্কেট বা শপিংমল গড়ে উঠছে। এসব মার্কেট বা শপিংমলগুলোতে শুধু সামনের দিকে কিছু দোকানে বেচাকেনা হয়, ভিতরের দিকের এবং উপরের তলার অনেক দোকানই দেখবেন ভাড়া না হওয়ায় খালি পড়ে থাকে। আবার কিছু কিছু দোকান ভিতর দিকে চালু থাকলেও তাদের বিক্রি হয় খুবই কম। তাহলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসব চাহিদাহীন দোকানপাট গড়ে তোলার কি দরকার?
দোকানের চাইতে বর্তমানে বাসা ভাড়ার চাহিদা বেশি রয়েছে। ভবিষ্যতে এই চাহিদা আরো বৃদ্ধি পাবে। দোকান নির্মান না করে গৃহ নির্মান করে সেগুলো ভাড়া দিলেও মানুষের কিছুটা উপকার হতে পারে।
পৃথীবিতে হাজারো রকমের ব্যবসা রয়েছে। দোকানদার না হয়ে অন্য ব্যবসাওতো করা যায়। চিন্তা করে দেখুন, এমন কিছু তৈরি করা যায় কিনা যেটা আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমানে তৈরি হয়না বলে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আপনি সেই জিনিসটি তৈরি করে চাহিদা পুরন করতে পারেন। নতুন ধরনের কোন সার্ভিস মানুষকে দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখুন। এমন কোন কৃষি পন্য উৎপাদন করুন যেটা আপনার এলাকায় উৎপাদন হয়না, দুর থেকে কিনে আনতে হয়। আপনি সেই চাহিদা পুরন করতে পারেন।
মূল কথা সবাই মিলে একটি খাবার নিয়ে টানাটানি করলে কারো ক্ষুদাই পুরন হবেনা। একবার শুনেছিলাম বাংলাদেশে কেউ কোন ব্যবসা করে কিছুটা লাভ করলে অন্য সবাইও সেই ব্যবসায় ঝাপিয়ে পরে। এরপর দেখা যায় যে আগে যে লাভ করেছিলো তারও আর লাভ হয়না এবং নতুন যারা সেই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে তাদেরও লাভ হয়না। সেজন্য একই ধরনের ব্যবসায় বেশি মানুষ যুক্ত না হওয়াই ভালো। যেকোন ব্যবসা করার আগে খেয়াল করে দেখুন, আপনি যে ব্যবসা করতে চাচ্ছেন ইতিমধ্যে সে ব্যবসায় কত মানুষ যুক্ত আছেন। নতুন করে সে ব্যবসায় যুক্ত হলে আপনি যথেস্ট লাভ করতে পারবেন কিনা সেটা ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
Add Comment