ভারতে গত কিছুদিন ধরে গঙ্গা নদীতে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। শত শত লাশ স্রোতে ভেসে আসছে অথবা নদীর তীরে বালিতে চাপা দেয়া অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে।
ভারতের উত্তর প্রদেশের কয়েক জায়গায় নদীর তীরে এই দৃশ্য দেখা গেছে। ধারনা করা হচ্ছে এগুলো কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া মানুষের লাশ। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে ভারত এখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভারতে এ পর্যন্ত আড়াই কোটি মানুষের সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং মারা গেছে ২ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে এই ভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আসলে সরকারি প্রতিবেদনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
নদী তীরে খুঁজে পাওয়া মৃতদেহ, দিনরাত জ্বলতে থাকা চিতাগুলো এবং শ্মশানগুলোতে মৃতদেহ পোড়ানোর জায়গার অভাব, এসব দিক বিবেচনা করলে ভারতে করোনায় মোট মৃতের এমন একটি সংখ্যার আভাস পাওয়া যায় যেটির সাথে সরকারী পরিসংখ্যানের বিরাট পার্থক্য থেকে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে গঙ্গায় ভেসে আসা এসব লাশের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। যথা সনাতনী বিশ্বাস ও দারিদ্রতা।
ঘটনাটি প্রথম আলোড়ন সৃষ্টি গত ১০ মে যখন ৭১টি লাশ উত্তর প্রদেশে বিহার সীমান্তের কাছে চাউসা গ্রামের নদী তীরে ভেসে আসে।
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে পচে যাওয়া এসব লাশের ময়না তদন্ত করা হয়েছে, এগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এরপর নদী তীরের গর্তে এগুলো কবর দেয়া হয়েছে। তাদের সন্দেহ লাশগুলো হয়তো নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এরকম ভেসে আসা আরও লাশ আটকানোর জন্য পুলিশ নদীতে জালও পেতেছে।
এর পরদিন(১১ মে), চাউসা গ্রাম হতে ছয় মাইল দূরে উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার গাহমার গ্রামের কাছে নদী তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায় একেবারে পচে যাওয়া কয়েক ডজন বিকৃত লাশ। কুকুর এবং কাকের খাবার হয়ে উঠেছিল এসব মৃতদেহ।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কয়েকদিন ধরেই নদী তীরে এরকম লাশ ভেসে আসছিল, এখান থেকে যে পচা গন্ধ ছড়াচ্ছিল সেটির ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষে অবগত করা হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর যখন ভাটিতে চাউসা গ্রামে অনেক লাশ পাওয়ার খবর দেশব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি করে কেবল তখনই কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি আমলে নেয়।
পাশের জেলা বালিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেখানে গ্রামবাসীরা যখন গঙ্গায় সকালে গোসল করতে যান, তখন তারা ডজন ডজন পচে ফুলে ওঠা লাশ নদীতে ভাসতে দেখেন।
কেবল নদীতেই লাশ ভাসতে দেখা যায়নি, নদীর তীরে বালির নীচেও চাপা পড়ে ছিল বহু লাশ।
ভারতে হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে সাধারণত মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘জল প্রবাহ’ নামের একটি সনাতন ধর্মীয় রীতিও রয়েছে। শিশু, অবিবাহিত মেয়ে কিংবা সংক্রামক কোন রোগে বা সাপের কামড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার নিয়ম এই রীতিতে।
অনেক দরিদ্র পরিবার লাশ দাহ করার আর্থিক সামর্থ্য রাখে না। তারাও লাশ কাপড়ে মুড়িয়ে নদীতে ফেলে দেয়।
উত্তর প্রদেশের অধিকাংশ শ্মশানই/ক্রিমেটোরিয়াম এপ্রিলের শুরু থেকে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা মৃতদেহ দাহতে ব্যস্ত। অনেক জায়গায় লাশের চাপ কুলোতে না পেরে শ্মশানের বাইরেই খোলা মাঠে কাঠ দিয়ে লাশ পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। কিন্তু সেখানে হাসপাতালে মারা যাওয়া করোনা রোগীদের লাশই কেবল পোড়ানো হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীরাই বাড়িতে মারা যাচ্ছে যাদের মধ্যে অনেকে কখনো টেস্টই করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, যারা বাড়িতে মারা যাচ্ছে তাদের পরিবার গুলোই যখন কোন চিতার ব্যবস্থা করতে পারছেনা বা দাহ করার জন্য কাঠ পাচ্ছেন না, তারাই লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে অথবা লাশ নদীর পাড়ে চাপা দিচ্ছে। অনেক গরিব পরিবার যাদের লাশ দাহ করার মতো সামর্থ্য নেই, তারাও একই কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই ধরনের ঘটনা সারা বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। গত বুধবার রাজ্য সরকার এরকম ‘জল প্রবাহ’ নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে যেসব গরীব পরিবারের লাশ দাহ করার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে।
অনেক জায়গাতেই পুলিশ নদী হতে লাশ টেনে তুলেছে। নদীতে মাঝিদের ও জেলেদের সাহায্য নিয়েও অনেক লাশ তীরে আনা হয়েছে। সেখানে এসব লাশ খাদে ফেলে কবর দেয়া হয় অথবা চিতায় তুলে দাহ করা হয়ছে।
পুলিশ জানিয়েছে তারা নদীতীরে এবং শ্মশানঘাটে টহল দিচ্ছে। যাতে কেউ নদীতে লাশ ফেলতে না পারে বা নদীতীরে কবর দিতে না পারে। কিন্তু এখনো প্রতিদিন নদীতে দুই একটি করে লাশ খুঁজে পাচ্ছেন তারা।
Add Comment